এডুইন মরগ্যানের কবিতা : অনুবাদে তুষ্টি ভট্টাচার্য



এডুইন জর্জ মরগ্যান (২৭এপ্রিল ১৯২০ – ১৭ই আগস্ট ২০১০) ছিলেন একজন স্কটিশ কবি ও সফল অনুবাদক। স্কটিশ রেনেসাঁর একজন উল্লেখযোগ্য কান্ডারীও ছিলেন তিনি। ১৯৯৯ সালে তাঁকে প্রথম গ্লাসগো পোয়েট লরেট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০৪ সালে তিনি প্রথম স্কটিশ জাতীয় কবির (The Scots Makar) স্বীকৃতি পান। ১৯৩৭-এ গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ফ্রেঞ্চ আর রাশিয়ান ভাষা শেখেন। আবার এই ইউনিভার্সিটিতেই লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত হয়ে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত প্রফেসর জীবন শেষ করেন। সনেট থেকে কংক্রিট পোয়েট্রি – তাঁর লেখা কবিতা এতটাই বিশাল দূরত্ব নিয়ে চলত। তাঁর প্রথম কবিতা সমগ্র বেরোয় ১৯৯০ সালে। তিনি রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ ছাড়াও হাঙ্গেরিয়ান, ইটালিয়ান, ল্যাটিন, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, জার্মান এবং পুরনো ইংলিশে অনুবাদ করেছেন সারা জীবন ধরে। তাঁর কবিতায় অ্যামেরিকান বিট পোয়েমের প্রভাব ছিল। এর প্রভাবে ১৯৬৮সালে ‘স্টার্লিং ইন জর্জ স্কোয়ার’ নামে একটি কবিতা লেখেন। ‘দ্য ডেথ অফ মেরিলিন মনরো (১৯৬২), ‘দ্য বিলি বয়েস’ (১৯৬৮), ‘আ গুড ইয়ার ফর ডেথ’(১৯৭৭), ‘পোয়েম ফর দ্য ওপেনিং অফ স্কটিশ পার্লামেন্ট’ (৯ই অক্টবর ২০০৪) যেমন তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতা তেমনি বেশ কিছু প্রেমের কবিতাও লিখেছেন, যার মধ্যে ‘স্ট্রবেরি’ ও ‘আনস্পোকেন’-এর নাম উল্লেখ করতেই হয়। এমনকি এই সময়েও (২০শে ডিসেম্বর, ২০১৬) টাইমসের লিটারারি সাপ্লিমেন্ট-এ মরগ্যানের ‘দ্য ডেমনস অ্যাট দ্য ওয়াল অফ টাইম’ কবিতাটি সেই সপ্তাহের সেরা কবিতা নির্বাচিত হয়েছিল। এখানে আমি ওঁর কয়েকটি কবিতার অনুবাদ করার ধৃষ্টতা দেখালাম মাত্র!  (তুষ্টি ভট্টাচার্য)  




কালের দেওয়ালে সে এক দানব

আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম।
অথচ আমি ছিলাম তাজা এক জ্বালানীর মত
সমতলের ধংসস্তূপ আমাকে চিনল না,
এক বিমূর্ত ঝলকের পরে – আমাকে পিসে দিল। 
মহাত্মার মত এক চওড়া হাসি চোয়ালে চেপে রেখেও
বাধার দেওয়ালগুলো দেখে আমি হাসিতে ফেটে পড়েছিলাম
বার্নিশ করা অন্ধকার আমাকে শাসিয়েছিল
আমার দেখার মত প্রায় কিছুই ছিল না,
রঙচটা ভাস্কর্যের এক টুকরো ছাড়া
আঁকড়ে ধরার মতও আমার কিছুই ছিল না।
এই সমস্ত কিছুই কি আমাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য নয়?
 সকাল দুপুর রাত পেরিয়ে গিয়ে
একটার পর একটা পাহাড় ডিঙিয়ে যাওয়া নয়?
এর থেকেও ভাল কিছু হয়! দুর্বল হাতে গন্ধ খুঁড়ে যাওয়ার মত –
আমি জীবনের কথা বলছিলাম!

চড়াই ভেঙে ভেঙে ওপরে ওঠ এবার। সাবধানে কিন্তু!
খুশির খবর এ যাত্রায় পাকদন্ডী নুড়ি বিছানো নয়
আবার তীব্র শৈত্যপ্রবাহ ভেদ করে উড়ে যাওয়ার ডানাও নেই তোমার
নখ দিয়ে আঁচড় কেটো না আর – প্লিজ! অনুভব আর অনুসারে মন দাও।
ভাগ্যরেখার দুর্ভেদ্য লিপি কে যে কীভাবে খোদাই করেছে
আমার জানা নেই, যেতে হবে এটুকুই আমি জানি।
সেই সুন্দর জায়গায় নেমে যেতে হবে
এখন আমার পায়ের তলায় জমি, সেই পুরনো বাদামী ঝুঁকে পড়া ক্ষেত
যেখানে একটাও গুবড়ে পোকা পাবে না
নীল আকাশ আর ঝলমলে রোদের মধ্যে
একটি মাত্র দেওয়াল এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে
যার দিকে একবার তাকালেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেবে যেন!
আরও নীচে সমুদ্রের পারে একঝাঁক শহর থেকে
ধোঁয়ার কুন্ডলী পাক খেয়ে উঠছে
ওখানে কি যুদ্ধ চলছে?
কোথাও না কোথাও উত্তপ্ত চুল্লী আঁচ ছড়াচ্ছে?
আমি জানি এখানে, এই দেওয়ালেও যুদ্ধ লেখা হচ্ছে –
‘কখনও হের না’, ‘এখনই হেরে যাও’, ‘জিভ আর ঈশ্বরের মধ্যে একজনকে বেছে নাও’ 
তবুও তুমি আমাকে এত সহজে হারিয়ে দিতে পারবে না!
আমি সেই সন্ধ্যে পর্যন্ত বেয়ে বেয়ে উঠব
যতক্ষণ না তারাদের কাছে পৌঁছতে পারি
সেই দুর্ভেদ্য দুর্গ ঘেরা প্রাচীর পেরিয়ে যেতে
আমি একটা পুরো রাতকেও নিয়ে নিতে পারি।
একটা গোটা দিন, একটা পুরো রাত চলতে থাকব
যতক্ষণ না আমার শরীর থেকে ছায়া আলগা হয়ে
(যে ছায়া আদৌ ছায়ামাত্র নয়) দেওয়ালের মাথায় চড়ে বসবে

আমি জানি তুমি এখনও আমার কথা শুনতে পাচ্ছ
আমি উধাও হয়ে যাওয়ার আগেও তোমার ভাবা উচিৎ হয় নি যে
আমি তোমাকে দেখতে পাব না –
আমি বিফল হতে আসি নি।
আমি পিছিয়ে যেতে আসি নি।
তুমি দেখে নিও,
ওই দেওয়ালের পাঠোদ্ধার আমি করবই একদিন। 




সিগারেট

আগুন আমার, তোমাকে ছাড়া ধোঁয়া নেই
তুমি চলে যাওয়ার পরে
আমার অ্যাশট্রের ওপর তোমার সিগারেট জ্বলজ্বল করছে
আর ধূসর এক দীর্ঘসূত্র আমার কাছে পাঠাচ্ছে
আমি আশ্চর্য হয়ে হাসছি আর ভাবছি,
এত ভালবাসার এই সঙ্কেতকে বিশ্বাস না করে থাকা যায়!
একটা সিগারেট পড়ে আছে নন-স্মোকার ট্রের ওপর,   
যেভাবে শেষ নিঃশ্বাস কেঁপে ওঠে
যেভাবে বাতাসের তীব্র ঝাপটা মুখের ওপর এসে পড়ে - 
এ কিসের স্বাদ? এ কি কোন গন্ধ?
তুমি আবার এখানে এসেছ, তোমার তামাক ঠোঁট মাতাল করেছে।
ধোঁয়া, তুমি পিছনের অন্ধকারে পড়ে থাক
আলো নিয়ে বেড়িয়ে পড়ব 
যতক্ষণ না সমস্ত ছাই পেতলের ফুলগুলোর মাঝে ঘুমিয়ে পড়ছে
আমি বাঁচবো, আর রাতভোর পর্যন্ত
তোমার শেষ চুমু শুষে নেব। 




অনুপস্থিতি

আমার ছায়াকে-
হাওয়ার ঝাপটায় আমি জেগে উঠে দেখি
আলোআঁধারির মধ্যে পর্দাটা দুলছে
আর ছাদ থেকে ভেসে আসছে পাখিদের কলকল
আমার ঘরে তখন লন্ডনের ওপর থেকে বেয়ে আসা প্রথম আলো –
আমার শীত করে উঠল।
ঠিক কোন ভয়ে বাতাস আগুনের মত বেজে উঠল?
রাস্তার শান্ত আলোর সারি অনেক পেছনে মিলিয়ে যাচ্ছে দেখে
কার জন্য আমি আধো ঘুমে জেগে উঠলাম?
আগুন নেই,
শুধু বাতাস নিঃশব্দে বয়ে চলেছে।
কিন্তু স্বপ্নে যখন আমি জেগে উঠি, দেখি
তুমি ট্র্যাফিক পেরিয়ে দৌড়ে আসছ
আমাকে টেনে ধরছ, আমার হাঁটু আঁকড়ে রয়েছ
তোমার চোখ কত কী বলে যাচ্ছে
যার কিছুই আমি বুঝছি না –
এখানে কিছু নেই, যদি তুমি এখানে থাকতে!

ভোরের সেই শান্ত বাতাস এখন ধীরে ধীরে
হাজার হাজার ঘুড়ন্ত চাকার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
আলো প্রকাশ্য হয়েছে, বাতাস চিৎকার করছে।
জানুয়ারির এক সাধারণ দিন আজ।
ছায়া, তুমি কি পথের শব্দ শুনতে পাচ্ছ?
তুমি কি আমার আমার গোড়ালিতে আটকে আছ? তুমি কি আছ?
আর আমি সমস্ত কাগজ ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।





স্ট্রবেরি

যেমন আমাদের ছিল
তেমন স্ট্রবেরি আর নেই
সেই ভ্যাপসা দুপুরে
খোলা ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর
সিঁড়িতে মুখোমুখি বসে
তোমার হাঁটু আমার হাঁটুতে রেখে
কোলের ওপর নীল প্লেটে
দুপুরের রোদে স্ট্রবেরি 
চকচক করছিল।
ওদের চিনিতে ডুবিয়ে
চোখে চোখ রেখে
তাড়াহুড়ো না করে
আমরা খাচ্ছিলাম।
পাথরের ওপরে
খালি প্লেট দুটোয় 
আড়াআড়ি দুটো ফর্ক
কারুর জন্য পড়েছিল
মিষ্টি সেই বাতাসে
আমি তোমার দিকে
ঝুঁকেছিলাম 
আমার বাহুতে
একলা শিশুর মত তুমি
স্ট্রবেরির গন্ধ ভরা
উৎসুক তোমার মুখ
আমার স্মৃতিতে
আবার জেগে উঠেছে
আমাকে ভালবাসতে দাও

আমাদের ভুলে যাওয়ার
ওপর রোদ পড়ুক
এক ঘন্টার তাপে
তীব্রতা ফিরে পাক
আর কিলপ্যাট্রিক পাহাড়ে
গ্রীষ্ম আলো হয়ে ফুটুক।

ঝড় এসে প্লেট
সাফ করে যাক।



14 comments:

  1. বাহ্‍। অনুবাদ মনেই হচ্ছে না। এতটাই প্রাঞ্জল। খুব ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  2. এটাকে উপহার হিসাবে নিলাম, ভালোলাগল।

    ReplyDelete
  3. egulo itself ek ekta kobita mone holo amar ebong onake porar icche multiplied holo :)

    ReplyDelete
  4. ভালো অনুবাদ করেছিস তুষ্টি । অনুবাদের লাইনটা ছাড়িসনি ।

    ReplyDelete
  5. তুমি এত ভালো অনুবাদ কর! খুব সাবলীল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই নিয়ে দ্বিতীয়বার করলাম মাত্র!

      Delete
  6. ভীষণ সাবলীল অনুবাদ l ভালোবাসা নিও l

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোমাকেও ভালবাসা

      Delete