ফারসি ভাষার কবি মেহ্‌রদাদ আরেফানি-র কবিতা



পাঠ ও ভাষান্তর : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়


তিনি মেহ্‌রদাদ আরেফানি। জন্ম, ১৯৬৩ জুলাই, উত্তর ইরানের বন্দরাঞ্চল শাহসবরেনব্বই দশকের শুরুতে লিখতে এসেছেন ফারসি কবিতায়। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী, বলা ভালো রাজনৈতিক চেতনা বিরাট ভূমিকা নিয়ে আছে যাঁর লেখায়কিন্তু কোনওভাবেই ওঁর কবিতাকে আমাদের চেনা রাজনৈতিক কবিতাগুলোর মতো বক্তৃতাধর্মী কিংবা বাগাড়ম্বরপূর্ণ বলা যায় নাস্লোগানধর্মী তো নয়ই। বরং, পলিটিক্যাল হয়ে উঠেছে পোয়েটিক্যাল।
১৯৯৩ সালে তিরিশ বছর বয়েসে যখন মেহ্‌রদাদ-এর কবিতা প্রথম ‘আদিনে’, ‘গার্দুন’ এই পত্রিকাগুলোয় বেরোয়, নিষিদ্ধ হয়ে যায় সেগুলো ইরানে। বর্তমানে এই পত্রিকাগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে মেহ্‌রদাদ-এর প্রথম বই ‘সূর্যালোকের শাখা’ (‘ব্রাঞ্চ অফ সানলাইট’) ছাপা হয়েছিল, কিন্তু ডিস্ট্রিবিউট করা যায়নি। নিষেধাজ্ঞা এসে যায় তার আগেই।
পনের বছর বয়েসে ইসলামিক রেভোলিউশনের প্রেক্ষাপটে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। কিন্তু প্রভাবশালী ইসলামি মৌলবাদের কাছে মেহ্‌রদাদের ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী বেখাপ্পা হয়ে দাঁড়াল। ফলত জেল। তখন আঠার বছর বয়েস। ’৮৭ সালে পালিয়ে যান সোভিয়েত ইউনিয়নে। ফিরে আসেন কিছু মাস বাদে। তারপর এক জেল থেকে আরেক জেলে ঘুরে ঘুরে কাটে আরও পাঁচ বছর। রাজনীতি ছেড়ে কবিতা লিখতে এলেন, সেখানেও পেছনে তাড়া করে বেড়ালো রাষ্ট্র ও তার ধর্মশাসন। ‘সূর্যালোকের শাখা’র ওপর নিষেধাজ্ঞা এলে, তারও ক’ বছর বাদে ২০০০ সাল থেকে শুরু হয় মেহ্‌রদাদ-এর পালিয়ে বেড়ানো জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়। ইরান থেকে পালিয়ে ইস্তানবুল, সেখান থেকে ইতালি, বেলজিয়াম হয়ে বর্তমানে ব্রাসেলসে থাকেন। ব্রাসেলস থেকেই ২০১০-এ প্রকাশিত হয়েছে ওঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, ‘গাছ থেকে গাছে’ (‘ফ্রম ট্রি টু ট্রি’)
কবির প্রতিরোধ কিন্তু শেষ হল নাইরানের সেন্সরশিপ এবং ধর্মশাসনের বিরুদ্ধে ব্রাসেলসে বসে ইউটিউব এবং অন্যান্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে লাগাতার কাজ চালিয়ে গেলেন ও যাচ্ছেন। তাঁর যে কবিতাকে রাষ্ট্র দমন করতে চেয়েছিল, ছাপা বই পৌঁছতে দেয়নি একজন পাঠকের কাছেও, ইন্টারনেটে ধানের বীজের মতো ছড়িয়ে দিয়েছেন সেই কবিতাকে মেহ্‌রদাদ 
কাজ থেমে থাকে না। কোনওদিন থাকেনি। কেউ পারেনি স্রোতের চলমানতাকে রুখতে। ঘরগুলো শুধু পালটে যায়। কখনও সেটা তেহরানের কুখ্যাত এভিন জেল। কখনও ব্রাসেলসের ফ্ল্যাট। কখনও এরোপ্লেনের কেবিন, কখনও ক্রোয়েশিয়ার জেল। ঘরগুলো শুধু পালটে গেছে। এবং এই জেল ছড়িয়ে সারা পৃথিবীতে। এক জায়গা থেকে পালিয়ে আরেক জায়গায়, সেখান থেকে আরেক জায়গায়...  জীবনের একটা বিরাট সময় এভাবেই কেটেছে মেহ্‌রদাদ-এর। ওঁর একটা কবিতার লাইন, ‘আমি অ্যাম মুভিং ইওর লাগেজ ইন মাই মাইন্ড’ — এটাই বোধহয় এই আলোকসন্ধানী কবির আত্মজীবনী হয়ে উঠেছে, যেখানে কবিতা লেখাটাই একটা রাজনৈতিক ক্রিয়া।  
  

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ
‘ব্রাঞ্চ অফ সানলাইট’ (ইরান, ১৯৯২)  
‘ফ্রম ট্রি টু ট্রি’ (ব্রাসেলস, ২০১০)  


ঘর

কোনও ফোন আসেনি।
ইমেল ভর্তি হয়ে আছে কমার্শিয়াল বিজ্ঞাপনে।
লন্ডন ঠিক ততটাও লন্ডন নয়।
এই ঘর, অন্য যেকোনও ঘরের মতো।
এখানেই থাকি, কিংবা এভিন জেলে               পার্থক্য কীসে তৈরি হয়
ব্রাসেলসের ফ্ল্যাটে
অথবা ইরানে, বাবার বাড়িতে
কী তফাৎ?
ক্রোয়েশিয়ার জেল অথবা এরোপ্লেনের কেবিন
ঘর তো শেষ পর্যন্ত একটা ঘরই
তার আকার আয়তন শুধু পালটে যাচ্ছে
ফ্রিজও একটা ঘর।
একদম একটা জুয়েলারি বাক্সের মতো
কিংবা একটা জ্যামিতিবক্স।
অথবা একটা মাইক্রোওয়েভ, যাতে স্যান্ডুইচটা আবার গরম করলাম।


বন্দর

গলায় ফাঁস লাগা টাই বেঁধে সে ফিরে এল
সাথে কয়েকজন
দলিলের মাথায় স্টেপল করা পিনের মতো তাদের কপালে আঁচড়ের দাগ

এই মস্তির দিনে আমার কি ক্রেনের ওপর উঠে নাচা উচিত
নাকি হাইড এন্ড সিকের এই খেলায় আমি লুকিয়ে থাকার দলে?

প্যারিসে প্রমোদ বিহারের জন্য শাহসবরের বন্দরে আমাকে যেতে হবে
মোনালিসার সামনে দাঁড়িয়ে লম্বা হতে হবে আরও
আইফেল টাওয়ারের মুখোমুখি হয়ে মেঘের মতো এই দু’পাছা ঘষব

ভরসন্ধ্যার স্তনে বেশ্যার অলস পায়চারির চেয়েও অন্ধকার এই ভোর   

আলবানিয়া কিংবা পূর্ব ইউরোপ অথবা এশিয়ার কোনও ছাত্র
কিছুতেই কোনও পার্থক্য নেই
উগান্ডার একজন ডাক্তার, নাইজেরিয়ার ইঞ্জিনিয়ার কি কঙ্গোর একটা হীরে হতে গেলে

মেয়র রাস্তা অবরোধ করেছেন
জমাদার পেচ্ছাব করছে ইউনিভার্সিটির দেয়ালে
রামাদানের আকাশে ধূর্ত ধোঁয়া
জঙ্গল আর কোনও কাঠের গন্ধ পাচ্ছে না
শুধু তেল শুধু তেল
কপালে ছড়িয়ে আছে
জলের আঙুল এসে টোকা দেয় ট্যাঙ্কারের পাছায়


আপেল

বন্ধুরা ভবিষ্যৎ শুনতে পারে না
সবাই টকঝালমিষ্টিতে বেঁচে থাকবে
এই বিশ্বাসেই তারা আছে

একটা ভাঙাচোরা সমাধি আর একটা লন্ঠন
শুক্কুরবারের বাজার থেকে ছুটি নিল

একটা ফুলছাপ ডিশ আর ক’টা গোল গোল প্লেট
নিউ ইয়ার ভাঙল
একটা চাকু ছাল ছাড়াচ্ছে ভবিষ্যতের


হুকুমনামা

কুয়াশা ঢাকা এক সকাল হোক এটা
অথবা রাতের ফুলগুলোর ওপর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ঝরুক
ঝলমল করুক রোদ
অথবা গাছের কাছে এসে দাঁড়ানো বর্ষার তোড়ে           স্যাঁতসেতে হোক সব
অথবা গাছ নয়
এ এক কাঠের খাম্বা
না
একটা পাথরের দেয়াল
না

হয়তো একটা গাছই
হয়তো পেছনে সমুদ্র নিয়ে
এসব আসার আগে সুযোগ রয়েছে—
ঠিকে কাজের
প্রেমে পড়ার
দরজা খোলার
রুটির গন্ধের অথবা
জানলা দিয়ে বরফ দেখার

আপেলের স্বাদগুলো দেওয়াল হয়ে উঠছে
নানীর জায়নামাজ হয়ে উঠছে একটা বাঁধ
এই সীসার তীক্ষ্ণ ছুটে যাওয়ায়
ডালিমের গন্ধ একটা পথ অবরোধ হয়ে উঠছে


চিঠি

পোস্ট-অফিসে বাছাই করা হচ্ছে চিঠিগুলো
এদের মধ্যে যেগুলো পোঁছবে
তারা জড়ো করবে সব পড়শিদের একে-একে
টেবিল ছয়লাপ হবে চায়ের কাপে
চিঠিটা এখন লুকনো আছে
চিঠিটা শয্যাশায়ী
একটা হাসপাতালে
যার নামটা কেউই জানে না 




বিশেষ কৃতজ্ঞতা : আবোল ফ্রাওশান

2 comments:

  1. hukumnama ta sob theke bhalo laaglo... erokm r o porar ashay roilam...

    ReplyDelete
  2. বাহ অন্যস্বাদে ডুবলাম সময়ের দাড়া ভেংগে

    ReplyDelete