নিসর্গের সঙ্গীতজ্ঞ শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী : একটি রেখাচিত্র



Photo Courtesy: Nasir Ali Mamun/Photoseum

'আমি আর্ট কলেজে পড়তে চাই'
মায়ের আড়াল থেকে রাগী বাবার সঙ্গে কথোপকথন চালাচ্ছে এক সদ্য কিশোর উত্তীর্ণ যুবক ... ঠিক সরাসরি নয়, ভায়া মা। সেই যুগের ছেলেদের এতটা সাহসই ছিল না জন্মদাতার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলা।  বাবার ইচ্ছে ছেলে অন্তত স্নাতক হোক তারপর না হয় আর্ট কলেজ ... ।  অবশেষে ভদ্র, নম্র বিনয়ী কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল ছেলের কথাই মেনে নিলেন বাবা ... তবে তাই হোক। না তখন ছেলেটি জানে না আর্ট কলেজে পড়ার পর কি করবে, আঁকতে ভালো বাসে, ক্লাসে আঁকার পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় হয়, শিক্ষকরা স্নেহ করেন  ... ব্যস আরো ভালো করে আঁকা শিখতেই হবে।

বাবা নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ঢাকা চারুকলা অনুষদে ভর্তি করে দিলেন। এই বিষয়ে বরাবর ভাগ্যবান শিল্পী। ছোটবেলা মায়ের সূচীশিল্প দেখে হিজিবিজি আঁক কাটার যে নেশা মনে ধরেছিল ঈশ্বর পাঠশালায় সিনিয়র দাদা অজিত চক্রবর্তী ও বিমল করের আঁকাআঁকি মনে দৃঢ়তা আনে। অজিত চক্রবর্তী পরবর্তীকালে কলাভবনের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন আরও পরে বিশ্বভারতীর ভাইস চ্যান্সেলর। শিল্পকলাই যে এই ছেলেটির পরম আরাধ্য বিষয় হবে তা পাঠকরা সহজেই অনুমান করে নেন।

কথা বলছি বাংলাদেশের সমকালীন চিত্রশিল্পীদের দ্বিতীয় প্রজন্মের সবচেয়ে আবেগপ্রবণ শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরীর (১৯৩৭) শিল্পযাপন নিয়ে। আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে অধ্যক্ষ হিসাবে পেলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে।  আনোয়ারুল হক, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ এবং মহম্মদ কিবরিয়া ... এনাদেরকে পেলেন শিক্ষাগুরু হিসাবে। কলেজ থেকে কমার্শিয়াল আর্ট বা গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে  স্নাতক হবার পরে এই কলেজেই শিক্ষক হিসাবে  যোগ দেন । এইসময় সদ্য জাপান থেকে শিল্পপাঠ নিয়ে তাঁর রুমমেট হিসাবে হাজির হন ওনার শিল্পশিক্ষক মহম্মদ কিবরিয়া ... একই ঘরে ছিলেন দীর্ঘ সাত বছর। কিবরিয়াবাবু কাজ করতেন ঘরে বসে আর পাশে বসে দীর্ঘদিন সেই কর্মকান্ড নীরবে দেখতেন শিল্পী। এই সময়পর্বে তাঁর অভিজ্ঞতা জীবনের এক শক্তিশালী পাথেয় হিসাবে মনে করেন সমরজিৎবাবু। পরবর্তীকালে ওনার শিল্পকর্মে রূপের যে নির্যাসিত আকার এসেছে সেটা এই পর্বে সমৃদ্ধ হয়েছে বলে মনে করা হয়।

শৈশবের স্মৃতিসমৃদ্ধ গ্রামীণ অনুসঙ্গ এবং পরবর্তীকালে শহর বাসের অভিজ্ঞতা এই দুই শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরীর শিল্পপ্রেরণা। আলাপচারীতায় জানিয়েছেন 'আমি মনে করি, ছবির লাইনটাই হলো এর প্রাণ। লাইন দিয়েই ফর্ম হয়। লাইন টেনে টেনে আমি বৃত্ত করতে পারি, চতুর্ভুজ বানাতে পারি, ত্রিভুজ বানাতে পারি ... লাইনটা আমার ছবির মধ্যে আনা যায় কিনা দেখি'  মাছ, পাখি, কর্মরত পুরুষ, নারী, গাছ, নদী, ঘুড়ি, সেতু, সীমানা, বেড়া, স্থাপত্য, নৌকা, সূর্য, পতাকা এইসকল দৃষ্টিগ্রাহ্য উপাদানগুলিকে সহজবোধ্য রেখার সাহায্যে চিত্রপটে উপস্থাপিত করেন অবলীলাক্রমে, ফলে পরিচিত এইসব রূপকল্পগুলি রূপান্তরিত হয় জ্যামিতিক বিমূর্ত নকশায়। রেখাগুলির মধ্যবর্তী শূন্যস্থানগুলি ভরে দেন লাল নীল সবুজ হলুদ বেগুনী  ইত্যাদি সাহসী রঙে ... অনুভবে আসে এক দক্ষ ডিজাইনারের উপস্থিতি। 
নবান্ন ১৯৭০
'নবান্ন' শিরোনামে একটি ছবি দিয়ে আমরা শিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরীকে জানতে শুরু করব যেটি ১৯৭০ সালে তেলরঙে আঁকা। ছবির একেবারে সামনে মোটা গাছের সারি আর সেই গাছগুলির ফাঁক দিয়ে দলবদ্ধ মানুষ নতুন কাটা ধানের গাছ মাথায় করে বয়ে নিয়ে চলেছে। একেবারে শেষে গরুর গাড়িতেও বোঝাই ধান। গ্রামবাংলার এক সনাতনী সমৃদ্ধির প্রতীকি ছবি। এতে আছে পরিশ্রমের গান, সফলতার ফসল। ছবিতে মানুষের পুনঃ পুনঃ অবস্থা এক ডিজাইনার চরিত্রকে আভাসে বর্ণনা করে। আবার গাছের পাতার চলনও সেই বক্তব্যকে জোরদার বানায়। শিল্পীর পরবর্তী রূপকল্প কোন খাতে বইবে এই ছবি তার একটি প্রামাণ্য নিদর্শন বটে।

পুরাতন ঢাকা ১৯৭৩
আলোচ্য পরের ছবিটি ১৯৭৩ সালে রচিত, শিরোনাম 'পুরাতন ঢাকা'। তেলরঙে সৃষ্ট এই ছবিটি শিল্পীর দীর্ঘ পুরাতন ঢাকার বসবাসের রূপকল্প। ছবিটিতে লক্ষ করতে দেখব আকাশের অস্তিত্ব প্রায় নেই, ঘিঞ্চি ঠাসা রচনা। বড় বড় গায়ে লাগানো বাড়ি , ল্যাম্পপোষ্ট, মানুষ অথবা গাছের অস্তিত্ব সামান্যই। বস্তুর আকার জমাট বাঁধা পিন্ডের মতন, রঙের ব্যবহার বলিষ্ঠ ... এই ছবিটিকে পরবর্তী নগর-নিসর্গের প্রাথমিক রূপও বলা যেতে পারে।

গ্রামীণ নারী ২০০৬
বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীর সৌন্দর্যকে শিল্পী সমরজিৎবাবু মূর্ত করতে চেয়েছেন তাঁর তুলিতে। চিত্রপটে সহজ সরল এক লজ্জাবতী গ্রামীণ নারী উপস্থাপিত, অনেকটাই সরাচিত্র থেকে অনুপ্রাণিত। স্নিগ্ধ সমৃদ্ধ বলিষ্ঠ রচনা, শিরোনাম 'গ্রামীণ নারী' রচনাকাল ২০০৬।

ময়ূর ২০০৬
একই বছর অর্থাৎ ২০০৬ সালে রচিত 'ময়ূর' শিরোনামে ছবিটিও কেবলই স্নিগ্ধতা নিয়ে আসে মনে, এখানে স্পেস ডিভিশন চমৎকার সৌন্দর্যময়। অধিক আলোচনা এই ছবির রস আস্বাদনে ক্ষতিকর।

কম্পোজিশন ৩
কম্পোজিশান -৩ শিরোনামে ছবিটি প্রায় নির্যাসিত নক্সায় পরিণত হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে দর্শকের মনে আসবে। একটু চোখ সওয়া হয়ে ধীরে ধীরে মাছের বিভিন্ন রূপ নিয়ে জমাট একটি রচনার স্বাদ পাবেন দর্শক। সেই সঙ্গে বিশুদ্ধ রঙ লেপনের অনুভূতিও, ছবিটির রচনাকাল ২০০৬।

ধর্মীয় হানাহানি তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যা ... কিছুটা রাজনৈতিকও বটে। শিল্পী তো প্রেম, সত্যের গানই  গাইবেন ... শিল্পী নিজের মত করে এর সমাধান খুঁজবেন, তাই সৃষ্টি করলেন ' দুনিয়ার সমতা' শিরোনামে অনবদ্য ছবিটি-
দুনিয়ার সমতা ২০১২
এক স্বর্গীয় নীল চিত্রপটে লাল-নীল রেখার চলনে ক্ষেত্র বিভাজিত হয়েছে। নানা ধর্মের দেউলগুলি তাদের স্থাপত্যের গঠন নিয়ে এখানে উপস্থিত। পরিশীলিত রেখা দিয়ে এই দেউলগুলির মধ্যে ঐক্য এনেছেন শিল্পী।  বিভাজিত খুপরিতে নীল-সবুজের নানা ছায়ার উপস্থিতি পরিশীলিত মনের পান্ডিত্য প্রকাশ পায়। শিল্পকর্মটির রচনাকাল ২০১২।

পুরাতন ঢাকা ২০১৩
পুরাতন ঢাকা শিরোনামে ১৯৭৩ সালের রচনাটি আমরা আগেই দেখেছি। একই শিরোনামে এই ছবির রচনাকাল ২০১৩ ... মধ্যে পার হয়ে গেছে ৪০টি বছর। বেড়েছে মেধা তাই এখানে শহরের রূপকল্প অনেকটাই নির্যাসিত ... সংক্ষিপ্ত, ইঙ্গিতে বর্তমান। পুরাতন ঢাকা শহরের খড়খড়ি দেওয়া জানালা, খিলান,  সিঁড়ি, ছাদের নক্সা এই চরিত্রগুলি জ্যামিতিক ক্ষেত্র বিভাজনে উপস্থাপিত। লাল, হলুদ, নীল, নীলচে সবুজ, গেরুয়া, বাদামী, খয়েরী এমন কি সাদা রঙের বুনটে যে অনন্য নান্দনিক মাত্রা যোগ করেছেন শিল্পী তা রসিক দর্শক সহজেই অনুভব করতে পারবেন। চিত্রপটে কর্মরত পুরুষ, আলাপরত কিশোর, পরিবার অথবা নির্জনে একক নারী বা পুরুষের উপস্থাপনা আমাদের এক শক্তিশালী  শিল্পবোধের সঙ্গে পরিচয় ঘটায়। এককথায় প্রতিটি শহরের যে এক ভিন্ন চরিত্র বর্তমান সেটা এই ছবিটি আমাদের শেখায়। 

ভালোবাসার একটি মুহূর্ত ২০১৩
চিত্রকলায় মূলত রোমান্টিক মানসিকতা নিয়েই কাজ করেন শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী। স্বভাবতই নারী-পুরুষের ভালোবাসাও তাঁর কাছে এক মূল্যবান বিষয়। 'ভালোবাসার একটি মুহূর্ত' শিরোনামে ছবিটি ২০১৩ সালে রচিত, যেখানে আমরা পাই চিত্রপটের একেবারে সামনে একজোড়া নারী-পুরুষের আলাপের মুহূর্ত।  চিত্রপটের উপরিতলে রোমান্সের লাল ছায়া রঙ দিয়ে শুরু রচনা শুরু, শেষ হয়েছে নীলচে-সবুজ শীতল পবিত্র প্রেমের জয়গানে। পুরুষের চুলের  ঢঙ্ এবং নারীর পোষাকের ধরণ এক আদি-অনন্ত সময়ের কথা জানান দেয়। এখানে লক্ষণীয় শহুরে আলাপরত এই মানব-মানবী নিসর্গে মিলে মিশে একাকার। জমাট নগর-নিসর্গে এদের মিলিয়ে দেওয়ার ভাষা যে এক দক্ষ ডিজাইনারের পক্ষেই সম্ভব এই ছবি তারই প্রমাণ।

দিনের শুরু ২০১৩
দিনের শুরু ... চিত্রপটে ডানদিক থেকে বামদিকে একটি সবুজ-লাল পাখি উড়ে যাচ্ছে, এই রঙটি বাংলাদেশের জাতীয় আবেগ হিসাবেও আমরা কল্পনা করে নিতে পারি।  সারি সারি বাড়ির দরজা বন্ধ, সূর্য সবে রঙ ধরতে শুরু করেছে। একটি বাড়ির সদর দরজা সবে খোলা হয়েছে ... কয়েকজন মানুষ সেই দরজা দিয়ে বাহিরে এসেছেন, এদের মধ্যে একজন সিঁড়িতে বসেই ঘুমের রেশ কাটাচ্ছেন। আমরা প্রতিনিয়ত এই ছবিই দেখে থাকি বাস্তবে ... কিন্তু এই দিয়ে সফল চিত্ররচনা !!!  এই অসাধ্য কর্মটি সম্ভব করেছেন বাংলাদেশের বর্ষীয়ান শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী মহাশয়। অ্যাক্রিলিকে আঁকা ছবিটির শিরোনাম 'দিনের শুরু' রচনাকাল ২০১৩।

শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরীর মতন ওঁর শিল্পকর্ম খুবই অন্তর্মুখি। ওঁর শিল্পকর্ম দর্শকদের প্রথম দর্শনেই আনন্দ দেয় ... এই সাধারণ ভালোলাগা স্তরটি ছাড়িয়ে যদি ওঁর সুর ও তাল -এর মধ্যে প্রবেশ করা যায় তবে শিল্পী ধীরে ধীরে নিজেকে মেলে ধরেন ... এই পর্বের যে নান্দনিক আলাপ দর্শক-শিল্পী-শিল্পকর্মকে ঘিরে গড়ে ওঠে তা ভাষায় সম্ভবত প্রকাশ করা যায় না ... রয়ে যায়  এক সার্থক নিসর্গ-সঙ্গীতজ্ঞের সুরের মূর্ছনা, অথবা এক অসামান্য পাঠ।

অমিত বিশ্বাস
কৃষ্ণনগর  ০৭/০১/২০১৭



3 comments: