বাক্ ১০৬ :: জানুয়ারি ২০১৭ :: সুহৃদ শহীদুল্লাহ



নিজেকে নতুন সহস্রাব্দের কবিতা কর্মী মনে করেন সুহৃদ শহীদুল্লাহ। জন্ম ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায়। এ-পর্যন্ত তাঁর 5 টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম বই  “ঈশ্বরের অটোবায়োগ্রাফি" প্রকাশিত হয়েছিল ২০০১ সালে । সর্বশেষ বই  'উদীয়মান সমাধি শিবির' বেরিয়েছে গেল বছর (২০১৬)। তাঁর কবিতা এবং অন্যান্য লেখালেখি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাঁর সার্বিক লড়াইয়ের অংশ । তাঁর যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন,"শিরদাঁড়া” ইতোমধ্যে তরুণতর এবং আভাঁ-গার্দ কবি-সাহিত্যিকদের গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে । তিনি বিশ্বসাহিত্য থেকে নিয়মিত বাংলায় অনুবাদ করে থাকেন । অতি সম্প্রতি তিনি রুমানিয়ার নব্বই দশকের কবিদের কবিতাসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশের সমসাময়িক কবিদের কবিতা নিয়ে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছেন শিরদাঁড়ায়। অনুবাদে তাঁর অন্যতম প্রধান কাজ রাইনার মারিয়া রিলকের "তরুণ কবির প্রতি চিঠি" সুহৃদ ২০১৪ ও ২০১৬ সালে প্যারিস আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে তাঁর কবিতা উপস্থাপন করেছেন । সুহৃদের কবিতা ও সাক্ষাৎকার ইতোমধ্যে ফরাসি, জার্মান ও ইংরেজি ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে । এ বছর কবির অনুবাদে প্রকাশিত হবে ফরাসিক লিন্ডা মারিয়া বারোস এর গীয়ম এপোলিনের পুরস্কা’-প্রাপ্ত কবিতার বই "রেজর ব্লেডে তৈরি বাড়ি" প্যারিস থেকে প্রকাশিত সাহিত্যকাগজ La Traductière-এ সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন কবি। (সোনালী চক্রবর্তী, বিভাগীয় সম্পাদক, এ-মাসের কবি)।



মিল 

দুঃস্বপ্ন দেখে যারা কাঁদে
আমি তাদের মতো নই

আমি তাদের কান্নার মতো 





জঙ্গলকাহিনি 

তোমার স্তনে হাত দিলে শুনি বাঘিনীর কান্নার আওয়াজ

নিজেকে মনে হয় নবীন পর্যটক; এসেছি অরক্ষিত বনে
অমীমাংসীত সীমান্ত অঞ্চলে;
কাটাতাঁরে ঝুলিয়ে রেখে গুলিবিদ্ধ সহোদরা--
এসেছি বুঝে নিতে
লাশ টেনে নেবার রোডম্যাপ

এসে তোমার স্তনে হাত রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি
আর তোমার ভেতরে ঘুমিয়ে পড়েছে গুলিবিদ্ধ বোন
একেবারে
আর ওর ঘুমের ভেতরে জেগে উঠছে সৌরজঙ্গল
মাথা তুলছে গাছ মাথা তুলছে পশু ও পাখি

আর আমি ক্রমাগত মাথা নত করতে করতে
ঢুকে পড়ছি পাকে-- জলমগ্ন রক্তাক্ত জঙ্গলে--
তোমার স্তনে
আঙ্গুলের ছাপচিহ্ন দিয়ে, 
তোমাকে সাক্ষী রেখে, মাতৃঘাতিনী



হাঁটা 

কোনো কোনো মানুষ হাঁটে
নিজ নিজ কফিন পিঠে নিয়ে

কোনো কোনো মানুষ হাঁটে
ঐ সব মানুষ আর কফিনের ছায়ায় ছায়ায়

বাকী সব মানুষ আবার হাঁটতে বেরোবে বলে
একটু জিরিয়ে নিতে
এখনো কবরে ঘুমায়



ক্ষমা 

ক্ষমা, এক অসাধারণ খেলা
আমি তার নিয়মও জানি না
তুমি কি শেখাতে চেয়েছিলে
আজ আর মনেও পড়ে না
শুধু মনে পড়ে- 
কারো কারো ক্ষমা পেলে
দু’একটা জীবন আরো
কারো কাছে থেকে চেয়ে নেওয়া যেতো
নিয়ম ও নিয়মহীন কিছু খেলা শিখবো বলে



চুল

অতএব স্মরণ করো সেই সব চুল যা আকৃষ্ট করেছিল তোমাদের পূর্বপুরুষদের;
বজ্রে, বিদ্যুতে বৃষ্টির সিঁড়ি বেয়ে ওরা নেমে এসেছিল শয়তানের সাপস্বরুপ—
নিশ্চয়ই সপ্ত আসমান জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের গায়েবি খোলস 
আর ঢেকে দিয়েছিল দো জাহানের অনেক নেয়ামত-- 
খেয়াল করো, তারা, তোমাদের পূর্বপুরুষেরা তাই অমাবস্যা রাতে রজ্জুকে সর্পভ্রম করে আতঙ্কিত হতো 
অথচ শয়তানের প্ররোচনায় চুল-পড়া দিয়ে বশ-ও করতে চাইতো তাদের কামনার নারী
আর অনেক চুলের ভিড়ে তোমরা কি দেখ নাই সেইসব চুল যাদের রঙে লেপ্টে দেয়া আছে দোযখের অন্ধকার; 
কেবল বিভ্রান্তরাই ওসবের ভেতরে খুঁজে পাবে বিদ্যুৎ-স্ফুলিঙ্গ আর কল্বের আরাম; 
অভিশপ্ত ওরা নিজেরাই বেছে নিয়েছে নিজেদের অলঙঘনীয় কর্মফল-- 
আমৃত্যু দোযখ পাহারার


পাঠ 

রাত্রির চিৎকারে কেঁপে ওঠে পাখির শৈশব
গৃহযুদ্ধের শেষে এই দেশে বৃষ্টি নামে
ধুয়ে যায় ব্রেইল পাঠ্যসহায়িকা
একজন অন্ধমানুষ,
একা, 
আরেকজন অন্ধ মানুষের খোঁজে হেঁটে হেঁটে
খুঁজে পায় নিজস্ব সমাধিলিপিকা--  পড়ে ঠোঁট ছুঁয়ে ছুঁয়ে

উড়ে আসে পাখির পালক, হাওয়া পরিখা ধরে,
রাত্রির চিৎকারে কাঁপে ভিজে-ওঠা শান্তিপতাকা



পরিচয় 

পেটের ভিতরে তোমার গুঁজে দিচ্ছি নৃশংস পাখির পালক
ওইটুকু নিশানা আমার তুমি বয়ে নিয়ে যাও সংসারে
যেখানে জাতিস্মর কুকুর পাহারা দেয় নাবালিকা গর্ভবতীদের

ওদের যে কোনো একজন আমার মা

ওদের যে কোনো একজনের নাম পাখি
আমি তার গোপন পালক




পদায়ন

তুমি আমার সর্বনাম



সম্পর্ক

প্রতিটি মৃত পুরুষ আমার সহোদর
প্রতিটি মৃত নারী তোমার সহোদরা
ওরাও দুশমন নয় চিরতরে
বেঁচে আছে যারা
আমাদের আয়ূ চুরি করে

আমাদের দেখা হয়
নিয়মিত
শুধু
মৃতদের বাড়ি
দেখি--
আমাদেরই জীবন্ত মুখ
মৃতমুখ দেখতে এসে

মুখে মুখে কারা এ-কেচ্ছা ছড়ায়
আয়নার গভীরে বসে



কাহিনি

ঘুমাতে যাবার আগে খুলে দিই অশেষ এক্যুরিয়াম
তোমার ঘুমন্ত দেহে মাঝরাতে একে একে ফুটে উঠে মাছেদের চোখ
ওদেরও ঘুম পাড়াতে হবে বলে গান গাই ঘুমপাড়ানিয়া
সে-গানে যেসব রাতে তোমার ঘুম ভাঙে
সেই সব রাতে আমরা যৌনসংগম করি
আর সংগম শেষে হুলস্থুল জলে
           তুমি কাঁদো
           আমি কাঁদি
আমাদের দ্বৈত কান্নার সুরে এ অঞ্চলে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায় ভাটিয়ালি


17 comments:

  1. মিল....বারবার পড়লাম

    ReplyDelete
  2. তুমি কি শেখাতে চেয়েছিলে
    আজ আর মনেও পড়ে না
    শুধু মনে পড়ে-
    কারো কারো ক্ষমা পেলে
    দু’একটা জীবন আরো
    কারো কাছে থেকে চেয়ে নেওয়া যেতো

    ভীষণ লাগল।

    ReplyDelete
  3. অসাধারণ। স্তব্ধবাক। বুঝলাম এই কবিতাগুলোর কাছে ফিরে আসতে হবে আবার, বারবার। আবার পড়তেই হবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ! ফিরে ফিরে দেখা হোক আমাদের কবিতাকে উপলক্ষ করে।

      Delete
  4. প্রতিটা কবিতাই অনবদ্য।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ, আপনার অনবদ্য পাঠের জন্য।

      Delete
  5. বন্ধু সুহৃদের কবিতা বরাবর আমাকে শোক বিহবল পথে নিয়ে যায়। ক্রমাগত আমি হাঁটতে থাকি আর মাথার মধ্যে ভনভন করে ঘুরে বেড়ায় ঘুণপোকা যা আমাকে তিষ্টতে দেয় না।

    ReplyDelete
  6. এইসব শোক-বিহ্বলতা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে বন্ধুত্বে!

    ReplyDelete
  7. পরিমিত উচ্চারণ।। অনবদ্য।। খুব ভালো লাগা ...

    ReplyDelete
  8. ফরমালিন ছাড়া সুন্দর

    ReplyDelete
  9. রাত্রির চিত্‍কারে কেঁপে ওঠে পাখির শৈশব

    ReplyDelete
  10. Outstanding poetics of a genuinely genius poet! Kudos to this Poetry-Maestro of Bangladesh.

    ReplyDelete