বাক্ : এ-বছরের প্রথম প্রকাশ



।। বাংলা কবিতার মৃত্যু নেই। সে নিজেকে মৃত্যুঞ্জয় প্রমাণিত করেছে। চর্যাপদের কবিতাগুলো আজ আমাদের অনুবাদে পড়তে হয়। বিবর্তনের এই তো নিয়ম। আজকের বাংলাভাষাই একমাত্র বাংলা নয়। সম্ভবত আজ থেকে ২০০-৫০০-১০০০ বছর পরে আজকের কবিতাগুলো আবিষ্কৃত হলে সেগুলোরও অনুবাদ প্রয়োজনীয় হবে। ভাষা বদলে যাবে। প্রকরণ বদলে যাবে। প্রকাশমাধ্যম বদলে যাবে। এই বদলগুলোর মধ্যেই বাংলা কবিতা চিরন্তন ও অমর থাকবে। তার ক্ষয় নেই, ব্যয় নেই। কারন সে আজও বহে চলেছে, তার স্রোত আজও অফুরান। যাঁরা বলেন ‘জল বাড়ছে’, তাঁরা দুধের কথাই শুধু ভাবেন কেন, নদীর কথাও চিন্তা করুন।

।। মধুরের পাশেই থাক কিছু তিক্তস্বাদ। কিছু বাঙালি তাঁদের প্রিয় মানুষকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে এতটাই আদিখ্যেতা করে ফ্যালেন যে সেটাকে অশ্লীল বলা চলে। এদিকে নিজের বৃত্তের বাইরে তাঁরা অসম্ভব নিস্পৃহ। তখন প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, লেখক, অভিনেতা, পরিচালকদের সম্পর্কে যে সুরে কথা বলেন, মনে হয় তাঁরা নিজেদের অভদ্রতাকেই নিজেদের একমাত্র শক্তি মনে করেনকারো সম্পর্কে অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করার সময়েও দেখতে হয় যেন তাকে অপমান না করে ফেলি। মূল্যায়নের নাম অশ্রদ্ধা নয়। কাউকে আক্রমণ করার আগেও যে তাকে একটা নমস্কার জানাতে হয়, এঁরা জানেন না। এঁরা কোনোদিন যুদ্ধে যাবেন না। এঁরা ধৃতরাষ্ট্র।।

          ।। আসলে কেউ কেউ ফুটনোটে জায়গা পাওয়ার জন্য এত লালায়িত থাকে যে ইতিহাসের চলমান পাতাটাই শেষ অবধি তাঁদের হাতছাড়া হয়ে যায়। বাংলা কবিতার একেকটা বাঁককে এঁরা বাঁধ বানিয়ে রাখতে চান, নদীর বহমানতা কি এঁরা দেখেও দ্যাখেন না? নতুনের তো নিজেরই দুঃখের অবধি নেই, আর কেন তাকে এঁরা ক্লেশ দিতে চান, বোঝা যায় না।।

          ।। তিরিশ বছর বয়সী কবি কুড়ি বছর বয়সী কবিকে বয়সের জোরে চুপ করিয়ে দিতে চান। চল্লিশ বছর বয়সী কবি তিরিশ বয়সীকে, পঞ্চাশ বছর বয়সী কবি চল্লিশ বয়সীকে, ষাট বয়সী কবি... আচ্ছা বয়স কবে থেকে কবির গুণ হোল? বয়স তো কবির বিষ বলেই জানি। তারুণ্য ও যৌবন যিনি হারিয়েছেন, পাকা চুল দেখিয়ে মান্যতার দাবি যিনি করছেন, কবিতার বাগানে তাঁর কোন কাজ? তিনি তো ফলের দোকানে যাবেন ভিটামিনের খোঁজে! আজ থেকে ২০০ বছর পরে কিন্তু জীবনানন্দ দাশ আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে একই প্রজন্মের কবি হিসেবে বিচার করা হবে, এবং সেই প্রক্রিয়া সম্ভবত শুরুই হয়ে গেছেসত্যিই যদি মহাকালে আস্থা রাখেন আপনি, এটা মনে রাখুন, মহাকাল তিরিশ-চল্লিশ বছরের ব্যবধানকে একটা হাইফেন ছাড়া কিছু মনে করে না।।

।। অস্বস্তিকর নতুন লেখকটিকে মুছে ফেলতে বাংলা সাহিত্যে দুটো অস্ত্র ব্যবহৃত হয়। একটা মারাত্মক অস্ত্র হল বিষোদগার। এটা সবচেয়ে বেশি সয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর কবিজীবনের প্রথমার্ধে, এই বিষ তাঁকে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্তও করেছিল (নীরদ  চন্দ্র চৌধুরীর ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’ দ্রষ্টব্য)এর চেয়েও ঘাতক অস্ত্র হল নৈঃশব্দ, অর্থাৎ খুব ঠান্ডা মাথায় একজনের সম্পর্কে সমবেতভাবে পুরোপুরি চুপ করে যাওয়া। এটা তাঁদের বেঁচে থাকাকালীন সবচেয়ে বেশি সয়েছেন রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরী, স্বদেশ সেন, বিনয় মজুমদারএছাড়াও অল্পবিস্তর সকলেই এই দুটো অস্ত্রের মার সহ্য করেছেন, যখনই অন্য কিছু লিখতে গেছেন। অবিশ্যি এই দুটো অস্ত্র লাগে বড় কবিদের ক্ষতি করার জন্য। মাঝারি কবিরা নিজেদের মধ্যে যে অস্ত্র নিয়ে লড়েন, সেটার নাম কাঠি।।

।। ফেসবুকের লাইক নিয়ে হাহাকার আর মেকি উদাসীনতার দিন আজও সমানে চলছে। রাম অনেক লাইক পায়, রহিম পায়না। এ থেকে কী বুঝবো? এটাই বুঝবো যে রাম রহিমের চেয়ে জনতার পছন্দসই মানুষযেমন সত্যজিতের চেয়ে আজ দেব অনেক জনপ্রিয়। ওটা গুরুত্ব বোঝায় না। অবিশ্যি কবিতা পোস্ট করে যাঁরা তিরিশের নিচে লাইক পান, তাঁরা সকলেই মহৎ কবি, এটাও ভাবা ঠিক নয়। ৫০০০ বন্ধুতালিকা নিয়েও একটা পোস্টে ৪০-৪৫ লাইকে থেমে যেতে হয়, ৪০০ বন্ধু নিয়েও ১০০+ লাইক হয়ে যায়। সবটাই জনগণের 'পছন্দ'-এর ব্যাপার। এর সঙ্গে উৎকর্ষের যোগ সামান্যই। আমার চেয়ে যারা লাইক কম পান, তাঁরা খুশি তো? যাঁরা বেশি পান, আমাকে আনফ্রেন্ড করতেই পারেন।।

          ।। যে লোক সকলের কবিতার তলায় ভালো-ভালো কমেন্ট করেন, তিনি আসলে কারও কবিতায় কোনো কমেন্ট করেন না। সকলের কবিতাতেই যিনি লাইক দ্যান, তিনি আসলে কারো কবিতাই পড়েন না, শুধু সামাজিক যোগাযোগ তৈরি করেন। এঁদের সিরিয়াসলি নেওয়া আর মরুভূমিতে মরীচিকার পেছনে দৌড়নো, একই ব্যাপার, জিভ একইরকম শুকনো কাঠ হয়ে থাকবে।।

          ।। বাক্ ১০৬’ এসে পড়ল ৭ই জানুয়ারি ২০১৭-র সকালে। সূচিপত্র বেশ দীর্ঘ হল। পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশিত হবে, যদি পরিকল্পনা না বদলায়, ২১শে ফেব্রুয়ারিআশা করি, এই দীর্ঘতা সেই দীর্ঘ বিরতির সমানুপাতিক হবে।।

          ।। পাঠকের জয় হোক। বাংলা কবিতায় বেজে উঠুক শিশুর প্রথম কান্না, কিশোরীর অনাবিল হাসি।

                                                                   (চিত্রঋণ :The Tree of Life’ চলচ্চিত্র)

5 comments:

  1. বেশ লাগলো এবারের লেখাটিও। সব সময় মনে হয় প্রাসঙ্গিক আর সময়োপযোগী, এবারও হল।

    ReplyDelete
  2. বাংলা কবিতার মৃত্যু নেই। সে নিজেকে মৃত্যুঞ্জয় প্রমাণিত করেছে। চর্যাপদের কবিতাগুলো আজ আমাদের অনুবাদে পড়তে হয়। বিবর্তনের এই তো নিয়ম। আজকের বাংলাভাষাই একমাত্র বাংলা নয়। সম্ভবত আজ থেকে ২০০-৫০০-১০০০ বছর পরে আজকের কবিতাগুলো আবিষ্কৃত হলে সেগুলোরও অনুবাদ প্রয়োজনীয় হবে। ভাষা বদলে যাবে। প্রকরণ বদলে যাবে। প্রকাশমাধ্যম বদলে যাবে। এই বদলগুলোর মধ্যেই বাংলা কবিতা চিরন্তন ও অমর থাকবে। তার ক্ষয় নেই, ব্যয় নেই। কারন সে আজও বহে চলেছে, তার স্রোত আজও অফুরান।' -এতটা ক্লাশ টেনের বাংলা কবিতা বিষয়ক আলোচনা বা রচনার মতো... খুব দরকার ছিলো! পড়ে যা মনে হল তাই লিখে দিলাম খারাপ পেয়ো না দাদা...

    ReplyDelete
  3. অভিনব প্রয়াস, মুগ্ধতার আবেশ ছুঁয়ে গেল মনকে, পুরোটা একবারে পড়তে গেলে পাছে রসভঙ্গ হয় তাই সময় নিয়ে পুরোটা পড়তে চাই মন্তব্য তারপর।

    ReplyDelete
  4. আপনাদের ডেট এ ভুল দেখাচ্ছে, আজ ২৪ শে জানুয়ারী ২০১৭

    ReplyDelete
  5. বিবর্তনের নিয়মে বর্তমানের শরীরে এখন কেবলই আদিখ্যেতা। এটা ঝেড়ে উঠতে পারাটাই কবির লড়াই।

    ReplyDelete