ছাত, কেয়াগাছ অথবা মেঘের কথা : জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়



'ছাত... যার মাথার উপ্‌রে নাই , সেই তার ঠিক দাম বুইতে পারে'। মূল্য'র মতো পালিশ করা শব্দ বোধহয় লোকটার আয়ত্তে ছিল না... তাই দাম বলেছিল। এক চোট হেসে নিয়েছিলাম। বলেছিলাম 'শুধু ছাত কেন, দাঁত নিয়েও তো লোকে একই কথা বলে!' সেও হেসেছিল।  তার মুখটা অনেকটা ঝাপসা হয়ে গেছে। শুধু মুখের সাদা দাড়ি, আর টাকঢাকা সাদা ফেজ টুপিটা মনে আছে, আর কপালের মাঝামাঝি একটাকার মত একটা দাগ।  ছয় স্টেশনের পরিচয়... এর থেকে বেশি কিছু রেখে যেতে পারেনি। তবে মাঝে মাঝে ছাতে এসে বেশ খানিকক্ষণ একা দাঁড়িয়ে থাকলে... হঠাৎই এই কথাগুলো মনে পরে যায়। আর একবার মনে পড়েছিল, যখন জেনেছিলাম এক বিপত্নীক মহাপুরুষ দেওয়ালে বাঁধানো স্ত্রীর ছবির সঙ্গে কথা বলতেন... তাঁকে নাকি দেখা যেত কোনও বিষয় নিয়ে ছবির সঙ্গে আলোচনা করতে। মহাপুরুষরা চিরকালই নাগালের অনেক বাইরে, তাঁর কথা থাক। ওই লোকটা যে মাথার ওপরে ছাতের কথা বলেছিল... ওটা আজন্ম পেয়েছি বলেই হয়ত তার সঠিক দাম আমি বুঝব না। কিন্তু ওই একই সুরে অন্য একটা কথা মাঝরাতের নিঃসঙ্গ ছাতটাকে বলি - এক চিলতে ছাতে, দু'দণ্ড খোলা হাওয়ায় বেঁচে থাকার দাম কেবল মধ্যবিত্তই বুঝতে পারে। স্বার্থপর ছাত... মূল্য উপলব্ধির অধিকার কেবল একশ্রেণীর মননে সঁপে দেওয়া  একচোখো ছাত। তবে সেখান থেকেই, এই মাঝরাতে যখন ফুসফুস ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আকাশের দিকে তাকাই; মনে হয় এই বেঁচে থাকার মুহূর্ত শোয়ার ঘরের থেকে অনেক ভাল। এই ভাললাগাকে ছেড়ে প্রতিবার নিচে নেমে আসাই একটা পিছু ডাক।  ওই পিছু ডাক ফেলে এখানে পড়ে থাকা যাবে না বলেই গভীর রাতের এই মুহূর্ত এত অতিপ্রাকৃতিক রিফিউজ। বিছানা ছেড়ে ছাতে আসার মধ্যে কোনও মন খারাপ নেই... কিন্তু এই নিঃসঙ্গ ছাতকে একলা ফেলে আবার বিছানায় ফিরে যেতে মন খারাপ হয়, ঠিক যতটা মন খারাপ সারা রাত ছাতে পড়ে থাকা হলুদ শাড়ীটার মধ্যে থাকে... যাকে দিনের নিয়ম তুলে নিয়ে যেতে ভুলে গেছে। অথবা যতটা মন খারাপ মৃদু মৃদু হাসে বৃদ্ধ প্রতিবেশী মিত্রবাবুর বন্ধ থাকা চোখে... রেডিওতে হিমাংশু দত্তর সুর শুনতে শুনতে। 
                                                                                                                   ---    ---    ---

রেডিও শুনতে ভাল লাগে - প্রসঙ্গ এলেই, আজকাল দেখি অনেকে গ্রামোফোনের যুগ, কলের গান, রেডিও... সব সুতোয় গাঁথতে শুরু করে। আমি কলের গান শুনিনি। কেবল ঠাকুর্দার পছন্দের বেসিক ডিস্কগুলো দেখেছি। তখন সেগুলো ভাঙতে শুরু করেছে। কিন্তু বড় রেডিওটা তখনও কাজ করত... আকাশবাণী, কলকাতা ''। বড় রেডিও পার করে ট্রাঞ্জিস্টার, ট্রাঞ্জিস্টার পার করে মোবাইল ফোনের এফ-এম ধরা। অথচ রেডিও জড়িয়ে যদি আমি এখনও শুয়ে থাকি... তাহলেই কি আমি প্রাচীন? সেপিয়া কিংবা সাদাকালো? আমার বালিশের পাশে যে বহুরাত করকর করে গেছে রেডিওটা, জ্বরের ঘোরে ভুল বোকার মত, স্টেশন পালটে গেছি... কমিয়ে, একদম কম করে রেখে তার ভলিউম। সেই সহবাসের সামাজিক স্বীকৃতি খুঁজতে ইচ্ছে হয়ে না... বরং না থাকা সেই রেডিওটা কেমন যেন প্রথম ভালবাসার প্রত্যাখ্যানের পাশে একটা মিষ্টি গন্ধ হয়ে থেকে গেছে। ঠিক সেই বেলফুল গাছের মত, যার ফুলের গন্ধ সন্ধে ডেকে আনতো। বিকেল হ'লে মগে করে জল ছুঁড়ে দিতাম যার পাতায় পাতায়। 
"গাছের গোড়ায় জল দিস, নাহলে মাটি শুকিয়ে যাবে। তবে শুধু গোড়াতেই জল দিস না... আগায়, ডালে, পাতায়... সব জায়াগায় জল ছিটিয়ে দিস। তবে, বেশি জল দিয়ে ফেলিস না... ছোট গাছ, পচে যাবে।" এক বৃদ্ধা নিকটাত্মীয়া বলেছিলেন। ছোট গাঁদাগাছ... মরসুমী, তাই এমনিতেই বেশি দিন থাকে না। এরপর নয়নতারা আর কৃষ্ণকলী গাছে বেশি যত্ন নিতাম, ছোট হলেও কিছু বেশি দিন থাকে। 
চান করতে করতে মনে হ'ত... বেশি জল ঢেলে ফেললে আমিও পচে যাব না তো? শেকড় না থাকলে বোধহয় পচার ভয় থাকে না। ঝপাস ঝপাস করে শব্দ করে করে মগে করে জল ঢালতাম, কোনওদিন হাত-পায়ের চামড়া সাদা হয়ে গেলে ভয় হ'ত... পচে যাচ্ছি! স্কুলের পাশে পুকুরের ধারে যেদিন অনেক লোক গিজগিজ করছিল, পুলিস এসেছিল... ভিড়ের মধ্যে দিয়ে একটা সাদা ধবধবে হাত দেখেছিলাম... নিথর। জলে পচে সাদা হয়ে গেছে। তবে ওভাবে পচিনি আমি। অনেক অনেক জল নষ্ট হয়েছে শুধু। হয়ত... শেকড় না থাকলে, পচারও ভয় থাকে না। তাই এখন, ছাতে সাজিয়ে রাখা টবগুলোকে সাবধানে, মেপে মেপে জল দিই। কেয়াফুলের গাছটাকে জল দিতে দিতে মনে হচ্ছিল, ছাতে আর বেশিদিন রাখা যাবে না তাকে। ষোড়শী যুবতীর মত বেড়ে উঠেছে, এবারে কোথাও জমিতে বসাতে হবে, না হ'লে এর সঙ্গেও সেই একই অন্যায় করা হবে যা পরিমলবাবু ওঁর বড় মেয়েটির সঙ্গে করেছিলেন। পরপর ছোট ভাইবোনগুলোর বিয়ে হয়ে গেল... এখনও বড় মেয়েটাকে দেখি চোয়াল শক্ত করে বাজারে সবজি কিনছে, তারপর রান্না করে স্কুলে পড়াতে যাবে। গলাটা কেমন কর্কশ হয়ে গেছে... অথচ দশ বছর আগে... যাই হোক, ওই গাছে জল দিতে দিতেই দেখলাম পরিমলবাবু পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে কারও সাথে হাত-মাথা নেড়ে অনেক কিছু বলছেন। ওনাকে দেখেই মনে হ'ল কেয়াফুল গাছটার দিকেও এবার নজর দেওয়া দরকার! পরিমলবাবুর প্রতি, প্রতিবেশী হিসেবে আলাদা কোনও আকর্ষণ, বা ওনাকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার মনোভাব আমার কোনওকালেই ছিল না। অথচ ওঁকে দেখলেই ওনার বড়মেয়ের মুখটা সবার আগে মনে পড়ে। একসময়ে মাথা নিচু করে কলেজে যাওয়া মেয়েটা, কেমন মাথা উঁচু করে, ঘাড় শক্ত করে জগৎকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যায়। সেই উদাসীনতার কাছে ক্ষমা চাইবার সাহস কে দেখাবে? 

                                                                                                                ---     ---     ---

'পরিমলবাবুর মেয়েটাকে দেখলে বড় মায়া হয়।' এইটুকুই বলাই কি ভাল ছিল? মায়া বা দয়ার মত পাড়াতুতো কাকাসুলভ মাথায় কিংবা পিঠে হাত রাখা কর্তব্যের স্পর্শ?  
একদিন রাতে, রুটির টুকরো ছিঁড়তে ছিঁড়তেই বলেছিলাম, "আজকাল পরিমলবাবুকে দেখলেই রত্নার মুখটা মনে পড়ে যায়।"  করবী কিছুই বলল না শুনে। টিভির দিকে তাকিয়ে রইল চুপচাপ। এক এক করে সব ক'টা রুটি গিলোটিনে চড়ল। টিভির বরাদ্দ ধারাবাহিকও শেষ হ'ল। করবীর ভুরু কোঁচকানো চোখের আড়ালেই অনেক কিছু থেকে গেল। শোয়ার পর, যখন চোখ বন্ধ করে ভাবছি... রাতে আর ছাতে যাব কি না... হঠাৎ ও'পাশ ফিরেই করবী বলে উঠল - "রত্নাকে ওর বাবা-ই বারণ করেছিল, তোমার কাছে পড়তে? নাকি তুমিই..." । সিদ্ধান্ত নিলাম, আজ রাতে আর ছাতে যাব না... ঘুম, কিংবা অতলান্তিক শূন্যতার কথা ভাবি... যেখানে পড়তে পড়তে সকাল হয়ে যায়। করবীও আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি। 

পরিমলবাবুরা যখন এই পাড়ায় আসেন, তখন রত্নার বয়স দশ-এগারো হবে। আর ভাইটার বয়স ৩-৪, নাক দিয়ে সর্দি গড়াত। বাকি দুই বোন এই পাড়ায় থাকাকালীন পৃথিবীতে এসেছে। চার সন্তান, যাদের মধ্যে তিনজন মেয়ে... এ কি মধ্যবিত্ত পরিমল বাবুর স্পর্ধার প্রকাশ? পরচর্চা হ'ল বোধহয়। প্রতিবেশী বলে সামান্য পরিচিতি ছিল, কিন্তু যেকোনও জায়গায় এমন ভাবে সিপিএম-কংগ্রেস নিয়ে টানাটানি শুরু করতেন, ইচ্ছেই করেই এড়িয়ে চলতাম। দু'কথা পরেই পার্টির নাম টেনে ক্যাচাকেচি পোষাত না! ওনার মত দেশ নিয়ে ওয়াকিবহাল বা ভাবাতুর নই... সে আর কি করা যাবে! বড় মেয়ের উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় উনি যে আমার কাছে এসেছিলেন, তাও পাড়ার কারও মুখে আমার নাম শুনে। মেয়ের হাতে মাইনে পাঠাতেন না। নিজে সে টাকা দিয়ে যেতেন, আর আমাকে ততক্ষণ সরকারী নীতি নিয়ে ওনার মতামত সহ্য করতে হ'ত যতক্ষণ না করবী চা-বিস্কুট নিয়ে আসছে। মাঝে মাঝে মনে হ'ত... কোথাও একটা বড় শূন্যতা থাকলে মধ্যবিত্তকে এমনভাবে রাজনীতি পেয়ে বসে। হ্যাঁ, ওনাকে দেখেই বেশি করে মনে হ'ত। তাই একবার জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম - 'আপনার কি মাঝে মাঝে খুব দুঃখ হয়?' 
বাজেট এবং মধ্যবিত্তকে মুর্গী করা নিয়ে ওনার বক্তব্য প্রকাশের মাঝে এমন প্রশ্ন হয়ত উনি আশা করেন নি। কেমন থমকে গেলেন। তারপর বললেন - "দুঃখ? কিসের দুঃখ?" 
বললাম, "তা তো জানি না... কিন্তু আপনার কি মাঝে মাঝেই দুঃখ হয়?" দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করায় খুব বিরক্ত হলেন। চায়ের কাপে অবশিষ্ট যা ছিল, তা এক চুমুকে শেষ করেই উঠে দাঁড়ালেন। তারপর তেতে উঠলেন... "মাঝে মাঝে দুঃখ পাওয়ার কি আছে? ও কি পুষে রাখার জিনিস? নাকি হজমের ওষুধের মত রোজ তিনবেলা খাওয়ার জিনিস? কি যে বলেন মশায়!" 
উনি চলে গেলেন। পায় চটি গলানোর সময় তাড়াহুড়ো করলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হোঁচট খেলেন। বার বার ঘুরে ফিরে বললেন 'পারেও... দুঃখ... হা হা।' মনে হ'ল আমিই একটা মস্ত দুঃখের পিণ্ড, যাকে দেখে ভয় পালিয়ে গেলেন। নাকি হঠাৎ মুখের সামনে আয়না তুলে ধরলে এই ভাবেই আমরা কেউ কেউ পালিয়ে যাই? 

করবী গম্ভীর ভাবে বলেছিল, "পাগলামীটা কম করো। এটা রোজকার। তোমাকে করে খেতে হয়।" 
ও-ই শুনেছিল, পাড়ার কোনও পলা বউদির কাছে... পরিমলবাবুর স্ত্রী চতুর্থ সন্তানের জন্মের পর থেকে অ্যাকিউট অ্যানিমিয়ায় ভোগেন। এই রক্তশূন্যতার কারণে পঞ্চম সন্তান গর্ভে আসার পরে নষ্ট করে দিতে হয়। পরিমলবাবুর স্ত্রী সম্বন্ধে বিন্দু মাত্র আগ্রহ না থাকলেও, এইসব শুনে বলে ফেলেছিলাম 'বল কি!'। ওনাদের বাড়িতে কেউ গেলেই নাকি পুরনো অ্যালবামের ছবি দেখাতে বসেন পরিমল বাবুর স্ত্রী। বিয়ের ছবি, প্রথম বেড়াতে যাওয়ার ছবি। তখন কীরকম কোমর অবধি লম্বা চুল ছিল... কেমন ভরাট চেহারা ছিল। সেই অ্যালবাম আমার দেখা হয়নি। ক্ষীণজীবী, হেরে যাওয়া এক মহিলাকে দেখেছি... কাঁপা কাঁপা হাতে করুণ দৃষ্টিতে অষ্টমীর অঞ্জলী দিতে। চোখ ছল ছল করে, প্রদীপের তাত আঁচলে গিঁট বেঁধে নিয়ে যান আরতির পর। 
চা খেতে খেতে একবার পরিমলবাবু করবীর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, "যাই বলুন... বউদি কিন্তু একদম ফিট আছেন এখনও।" প্রায় বলে ফেলেছিলাম, 'আমাদের একটি মাত্র সন্তান'... কিন্তু মাইনের খামটা তখনও ওনার পাঞ্জাবীর পকেটেই ছিল। করবী যে হাসির আড়ালে আমাকে নিষেধের শাসন করছে... পরিমল বাবুর বোঝার কথা নয়। আমি ওনার হাসি টেনেই বললাম... "হ্যাঁ, শুধু আমারই চুলগুলো ক'দিন পর আপনাদের কমরেডের মত পুরো হোয়াইট ওয়াশ হয়ে যাবে!" 

                                                                                                                ---     ---     ---

"We look before and after, 
And pine for what is not: 
Our sincerest laughter 
With some pain is fraught; 
Our sweetest songs are those that tell of saddest thought. "


"আপনি কলপ করেন না কেন?" 
টুয়েল্‌ভ পাশ করে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারেও আমার কাছে আসত রত্না... সেকেণ্ড পেপারের জন্য।  রোমান্টিক রিভাইভাল-এর মাঝে কলপের প্রসঙ্গ খুব একটা অবান্তর নয়... এমনই মনে হয়েছিল প্রশ্নের শেষে মিশে থাকা হাসি দেখে। আমিও হেসে বলেছিলাম, বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। মনে পড়ছিল - 'বিকেলে ভোরের ফুল' 
অথচ অল্প বয়স থেকে চুলে পাক ধরলেও, আজও ঠিক ততটাই কাঁচাপাকা আছে, যা দশ বছর আগে ছিল। 
তিনটে নিউ ইয়ার গ্রীটিংস কার্ড। আর শিক্ষক দিবসে পাওয়া তিন খানা কলম... এখনও সযত্নে রাখা আছে, থাকবেও। করবী কখনও জিজ্ঞেস করে নি এই বাড়তি যত্নের ব্যাপারে। দেখেছি, মাঝে মাঝে শো কেস্‌ পরিষ্কার করার সময় কার্ডগুলো খুলে দেখে... হয়ত না লেখা কিছু কথা পড়ার চেষ্টা করে। বার বার পড়ে দেখে, আগের বার কিছু অদেখা থেকে গেছে কি না। তারপর কিছুই নতুন না পেয়ে রেখে দায়, কার্ডের মাঝে দীর্ঘশ্বাস ভাঁজ করে। আচ্ছা... তিনটে আলাদা আলাদা শরীরের দীর্ঘশ্বাস মিশলে কি আলাদা কোনও রসায়নিক প্রক্রিয়া হয়? শুকিয়ে যাওয়া চ্যাপটা গোলাপের গন্ধ বেরোয় তখন? 

           করবী কিন্তু আমাকে কোনওদিনও রত্নাকে নিয়ে একটা প্রশ্নও করেনি! কিচ্ছু জানতে চায়নি কোনওদিন। প্রতিবার রেজাল্ট বেরনোর পর আমাদের দুজনকে প্রণাম করত রত্না। করবীর চোখে কেমন একটা অদ্ভুত হাসি দেখতাম, থুতনীতে হাত রেখে চুমু খেয়ে কেমন মিষ্টি হেসে বলত, "আরো ভাল রেজাল্ট করো... তোমার আরও ভাল হোক"। যেন ইচ্ছে করেই আমাকে দেখাতে চাইত... ওর মন টা আমি যতটা ভাবি, তার থেকে বহুগুণে বড়, দরাজ। হয়ত সত্যিই তাই... করবীও হয়ত মনে মনে বিশ্বাস করে এখনও, যে আমাদের ও ক্ষমা করে দিয়েছে। 
               আচ্ছা, রত্না সেদিন আমার বুকে মাথা রেখে কেঁদেছিল বলেই কি করবীর এত অভিমান? আমি জানি করবী ঘরে ঢুকতে গিয়েও পা পিছিয়ে নিয়েছিল চৌকাঠের বাইরে। পর্দার দুলে ওঠা, পর্দার ওপারে পরিচিত চুড়ির রিনরিন আমি শুনেছিলাম। কিন্তু কেন জানি না... সেসব কিছুই বিচলিত করে নি। রত্নাকে দূরেও সরিয়ে দিতে পারে নি। মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল... ততক্ষণ বুকে মাথা রেখেছিল, যতক্ষণ রাখতে ইচ্ছে হয়। তারপর যখন মুখ তুললো, চোখের কাজল গলে গাল বেয়ে পড়ছে নোনা ভেসে যাওয়ার সাথে। ওকে মাথায় হাত দিয়ে বললাম, "বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে ভাল করে জল দিয়ে নে। কাকিমাকে বল, তোয়ালে দিতে।" থার্ড ইয়ারটা আর ও শেষ করল না আমার কাছে। চার মাস বাকি থাকতেই চলে গেল। ওর বাবা বলল - 'মেয়ে বলছে, শেষ চার মাস ঘরে থেকেই মন দিয়ে পড়বে... এর মধ্যে যাওয়া আসা করে সময় নষ্ট করে লাভ নেই... এমনিতেই চাকরির যা বাজার, এর পর যে কী হবে..." এরপর বর্তমান শিক্ষা এবং কর্মব্যবস্থা নিয়ে অনেক কিছু বলছিলেন, শুনিনি।

যে চোখ নরম প্রশ্ন, উষ্ণ কৌতূহল, আর কিশোরীর বিস্ময়ের এতগুলো রঙ দেখিয়েছিলো... তার পাতার কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে অতি মৃদু ফুঁ দিতে পারিনি বলে আফসোস নেই। 
যে ঠোঁটে অনেক বার আঙুল রেখে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছি আসন্ন অস্থিরতা... তার স্বাদ নিতে না পারার আক্ষেপও হয়নি সেদিন। 
অথচ তার হঠাৎ করে সরে যাওয়া, আর কোনও ফিরে না চাওয়া... কেমন এক চূড়ান্ত অ্যাণ্টি ক্লাইমাক্স হয়ে গাঁথা রইল ফনী মনসার কাঁটায়। 
কাঁটা উপড়ে দিলে দুধ গড়িয়ে পড়ে, অতঃপর শুকিয়ে যায় ক্ষত। অথচ দুধের দাগ...

               ওর ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষার ঠিক ক'দিন আগে পাড়ায় পুলিশ এসেছিল। প্রতিবেশীরা বলাবলি করছিল সমীরণ বলে কোনও এক ছেলের সঙ্গে প্রেম ঘটিত ব্যাপার। ছেলেটির খোঁজ পাওয়া যায়নি, কিন্তু তাকে লেখা বেশ কিছু চিঠি রত্নার ঘরে পাওয়া যায়। ডায়েরীর পাতায় নাকি তার নামে কী সব লেখা। তার থেকে কিছু একটা পরিমলবাবুর হাতে লাগতেই অশান্তির সূত্রপাত। রত্না কিংবা তার মায়ের গলায় একাধিক বার গায়ে আগুন আর গলায় দড়ির কথা শুনে কোনও বিচক্ষণ প্রতিবেশী পুলিসে খবর দিয়ে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকের কর্তব্য করে। নাঃ আমি কোনওদিনও রত্নাকে কোনও চিঠি লিখিনি। আমি বা করবী কেউই পরিমলবাবু বা ওনার স্ত্রীয়ের সঙ্গে এই নিয়ে কোনও কথা বলার চেষ্টা করিনি। আলাদা আলাদা ভাবে, আলাদা আলাদা কারণে... আমরা কেউই চাইনি এই নিয়ে কোনও কথা বলতে। তবে আমরা জানতাম, রত্না সুস্থ আছে... পরীক্ষা দিতে অসুবিধে হয় নি। 
পরিমলবাবুর পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রতিবেশীদের অনেকেই এখনও বলেন - "ওই সমীরণ না কি যেন নাম ছিল... ওর সঙ্গে বিয়ে হ'তে দিলো না বলেই মেয়েটা এমন বেঁকে বসল!" 
করবী বলে... বিয়েটাই মেয়েদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হ'তে পারে না, যে যেমন ভাবে বেঁচে থাকতে ভালবাসে। কিন্তু বেঁকে বসার ব্যাপারে ও-ও কিছু বলতে চায় না। 

                                                                                                                ---     ---    --- 

"তোমার আমার বুকে যে কথা জাগে
চাঁদের তিলক আঁকা
গোপন রাগে
নদীর মুকুরে আজই মিলাল তারা 
রাতেরও দেউলে জাগে বিরহী তারা
ওগো তন্দ্রাহারা" 

পাড়ার প্রবীনতম রেডিওভক্ত মিত্র বাবুর মত সৌম্য-শান্ত আপনভোলা মানুষও মাঝে মাঝে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন... যখন ওনার রেডিওটা বিগড়ে যায়। "রেডিওটা হঠাৎ বেঁকে বসেছে!", বলে সেই স্কুলের ছেলেটির মত করে তাকান, যে কিছুতেই বুঝতে পারে না সব ঠিক লিখেও কী করে এত কম নম্বর উঠল! ছাত নয়... ওনাকে আমি বারান্দায় বসে থাকতে দেখেছি। রেডিওতে 'ভুলে বিছরে গীত', কিংবা পুরনো দিনের বাংলা গানের আসরে একের পর এক গান শুনতে শুনতে ওনার মুখে যে অদ্ভুত প্রশান্তি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে, তার সঙ্গে বর্ষার ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ ছাড়া আর কিছুরই তুলনা হয় না। ওই চোখ বন্ধ করে মিষ্টি হাসি দেখলে মনে হয় কোনও নির্বান প্রাপ্ত মহাপুরুষের দিকে চেয়ে আছি। মনে হয়, যতক্ষণ মানুষ এইভাবে হাসতে পারে, ততক্ষণ নিশ্চিৎ থাকা যায়, সে জীবনকে এখনও ভালবাসে... অনেকটা ভালবাসে। তার এখনও আরও বহুদিন জীবনকে দুহাতে জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, কোমল অথচ দৃঢ় আলিঙ্গনে। 
আমাকেও কি কখনও এমন হাসতে দেখা যায়? বারান্দায় বসে রেডিওমগ্ন মিত্রবাবুর ওই হাসি দেখিয়ে করবীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। করবী কেমন অদ্ভুত প্রতিধ্বনি করে বলল - "আমাকেও কি কখনও এমন হাসতে দেখা যায়? " 
           রত্নাকে আর কোনওদিন হাসতে দেখিনি আমি। রাস্তায় যাওয়া আসা করতে, পথে অনেকবারই মুখোমুখি হয়েছি। নির্বিকার ভাবে চলে গেছে পাশ দিয়ে, আমারও ডাকতে ইচ্ছে হয় নি। এই না ডাকার মধ্যে কোনও কিছুর হারানোর অনুভূতিও নেই। আর এখন তো ওকে আর সেই রত্না... সেই মানুষ বলে মনেই হয় না। আমিই বা কতটা সেইরকম আর? নিজেকেই কেমন অচেনা লাগে, প্রশ্ন করি - তোর কি সত্যিই ইচ্ছে হয় না, কেউ বুকে মুখ রেখে সেই ভাবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদুক? ইচ্ছে করে না, মাথায় হাত বুলতে বুলতে মন টা শ্রাবণে-বিকেলে মেঘ ভাঙা রোদের মত হয়ে উঠুক? ঠিক করবী যেভাবে কার্ডগুলো বার বার পড়ে, সেইভাবে উলটে পালটে নোটবুকের মুছে যাওয়া লাইনগুলো পড়তে পড়তে একসময় ফিরে আসি। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এমন পোয়েটিক জাস্টিসের কথা চিন্তা করা, বাস্তবতার প্রতি অপরাধ। পায়ের ওপর দিয়ে মোটর বাইক চলে গেলে, 'সরি কাকু' ছাড়া সভ্যতার আর কিছুই দেওয়ার নেই। 

               কেয়াগাছের কথাটা করবীকে বলতে, ও বলল - "বেশ তো, বড় হয়ে যাচ্ছে যখন... দরজার বাইরে মাটিতে বসিয়ে দিও।" দরজার বাইরে, মানে বাড়ির বাইরে চলে যাওয়া। আমি কিছু বলার আগেই আবার বলল, "পারুলদি বলছিল... রত্না একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছে, গিরিডিতে... সেখানে চলে যাবে।" আমি এবারও কিছু বললাম না। শুধু '' বলে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। করবী আবার বলল, "দরজার বাইরে রাখতে যদি না চাও, একটা বড় টবের ব্যবস্থা করতে হবে!" 
আমি বাথরুমের ছিটকিনি দিইনা ভেতর থেকে। পুরনো দিনের দরজা, কাঠ বেড়ে গেছে। আজও আলগা বন্ধ করেই, কলটা খুলে দিলাম। বালতি ভরতি হওয়ার শব্দ গমগম করে উঠল, করবীর দীর্ঘশ্বাস কে ছাপিয়ে। যদি কেয়াফুলের গাছটা বাইরে ভাল থাকে, তাহলে বাইরেই থাক, ব্যবস্থা করে দেব। 

                                                                                                                      ---     ---    --- 

“Out, out, brief candle!
Life’s but a walking shadow, a poor player
That struts and frets his hour upon the stage
And then is heard no more. It is a tale
Told by an idiot, full of sound and fury,
Signifying nothing.” 

রত্না কবে গেছিল জানি না। তবে এক সময়ের পর ওকে আর কোনওভাবেই দেখতে পেতাম না। না পথে, না ছাত থেকে। তবে পরিমলবাবুকে দেখলে ওনার বড় মেয়ের কথা মনে পড়তই। যেন এক প্রাকৃতিক নিয়মেই মনে পড়ে যেত। তবে ওনাকে কখনওই রত্নার কথা জিজ্ঞেস করিনি। ঠিক সংকোচ বা ভয় নয়, আমার চিরকালই মনে হ'ত... রত্নার বাবা হওয়ার যোগ্যতা ওনার নেই। অপেক্ষা করতাম, যদি করবীর মুখ থেকে কোনও খবর পাই। যেমন ও প্রতিবার নিজে থেকেই রত্নার খবর পৌঁছে দিয়েছে আমাকে, শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে, স্মিত হাসি নিয়ে। কিন্তু করবীও কিছু বলেনি আমাকে। 

প্রায় দেড় বছর কেটে গেছে, কেয়াগাছটা জমি পেয়ে ঝেড়ে উঠেছে। পূর্ণ যৌবনা গৃহবধুর মত লাবন্য তার শরীরে। গতকাল বিকেলবেলা ছাতের গাছগুলোকে জল দিতে দিতে দেখলাম একটা অটো গলির মোড়ে এসে থামল।  অটো থেকে যে মেয়েটি নামল তাকে দেখে রত্না বলেই মনে হ'ল। ছাত থেকে ঠিক বুঝতে পারলাম না, তবে মনে হ'ল যেন মুখে একটা হাসি লেগে আছে। হ্যাঁ, রত্নার মুখে হাসি লেগে আছে! অটো থেকে আরও এক জন মহিলা নামলেন, প্রায় রত্নারই বয়সী মনে হ'ল। দু'জনে একসাথে চলে গেল পরিমলবাবুদের বাড়ির দিকে। হ্যাঁ ওনার বাড়িতেই তো ঢুকলো দু'জনে। 

                                                                                                                      ---     ---    --- 

আজ কোন তিথি কে জানে! আকাশের চাঁদটা ঠিক ঈদের চাঁদের মত... বঙ্কিম আর সুন্দর! আর কিছু দূরেই জ্বল জ্বল করছে ধ্রুব তারা। দূষণের স্তর ভেদ করে আর আগের মত নক্ষত্রদের মেলা দেখা যায় না। তাও আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে ভাল লাগে। হেমন্তকাল বলেই বোধহয় একটা হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। ছাতের পাঁচিলটা হিমে ভেজা। কিছু কিছু জিনিস একসাথে মন ভাল করে দিলে মনে হয় আমিও মিত্র বুড়োর মত চোখ বন্ধ করে হাসি। কল্পনা করি, আমার হাসিতে সেই প্রশান্তি ফুটে উঠছে কি না। 

চোখ বন্ধ করে দেখার চেষ্টা করলাম। গতকাল বিকেলে ইচ্ছে করেই পাড়ার মোড়ে মুদির দোকানটায় গিয়ে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলাম। রত্নাকে হাসতে দেখার দৃশ্যটা কিছুতেই মন থেকে যাচ্ছিল না। প্রায় আধঘণ্টা পড় দেখলাম ওরা গলির মোড়ের দিকে এগিয়ে আসছে। ওরা দু'জনে - রত্না এবং ঐ ভদ্রমহিলা। দু'জনে কাছে আসতেই বুঝলাম সত্যিই রত্না হাসছে। সঙ্গে সেই মহিলাও হাসছেন। এবং সেই মহিলার মুখটিও আমার পরিচিত মনে হ'ল। রত্নার কলেজ পিকনিকের ছবিগুলোতে দেখা... রত্নার কলেজের বান্ধবী - বাসবী... হ্যাঁ বাসবী এত বছর পর এমনই দেখতে হবে। বাসবীর সঙ্গে একটু বেশিই ছবি তুলত রত্না। অনেক ছবিতে দুজনকে দেখেছি একসাথে... হাসতে। দু'জনেই হাসছে, দু'জনেরই একই রকম হাসি। হাসতে হাসতে দুজনে বড় রাস্তার দিকে গেল। তারপর একটা অটো ডেকে উঠে পড়ল ওরা। অটোটা চলে গেল আমাদের গলিময় যাপনকে পেছনে ফেলে। আমি একেবারেই চাইনি আমার মুখের হাসি ওরা দেখুক, দোকানের ভেতরেই রয়ে গেলাম ওদের আড়ালে। রত্নার মুখের ওই হাসিটা দেখার জন্যই যেন আমি যখের মত অপেক্ষা করছিলাম এতগুলো বছর! একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার যেন এক রাশ পাখি হয়ে কিচিরমিচির করে উড়ে গেল একটা জীর্ণ গাছ থেকে। 
নিজের বাড়িতে এত অল্প সময়ের জন্য মেয়েটা কেনই বা এলো, আর কেনই বা চলে গেল?... এই প্রশ্নগুলো সেখানেই বড়ই অবাঞ্ছিত। 

"একটা শাল গায়ে দিয়ে আসতে পারতে... নতুন ঠাণ্ডা"
করবীর গলার আওয়াজে চমকে উঠলাম। ও কখনও এত রাতে ছাতে আসে না। আমি এসেছি জানলেও আসে না। শুধু অস্ফুটে বললাম, 'তুমি?'
হাতের শালটা আমার কাঁধে জড়িয়ে দিয়ে বলল, "বয়সের খেয়াল রাখতে হয়...", করবীর গলার স্বর রাতের মতই শান্ত, প্রশান্ত - "রত্না ওই মেয়েটার সঙ্গেই এখন থাকে... বাসবী। তুমি দোকানে চলে গেলে, ও এসেছিল বাড়িতে ওর বান্ধবীকে নিয়ে। তুমি নেই শুনে জানতে চাইল... আমাদের ফোন নাম্বারটা এখনও এক আছে কি না।" 
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তুমি কি বললে?"
"কী আবার বলব?... নাম্বার চাইলে দেবো না?"
ছাতের অন্য প্রান্তে চলে গেল করবী ধীরে ধীরে। ওর ঠাণ্ডার ধাত, অল্পতেই ঠাণ্ডা লেগে যায়। এত রাতে ছাতে না থাকাই ভাল। 

বাসবীর কথা আমাকে আগেও বলেছিল রত্না। কিন্তু ওরা একসাথে থাকার কথা কখনও ভাবতে পারে, জানতাম না। এখন একসাথে থাকাটা আদৌ কোনও সম্পর্ক না অন্য কিছু... সেই ভাবনাও বিচলিত করে না। রত্নার বাড়ির কোনও চিঠিতে বা ডায়েরীর পাতায় বাসবীর নাম পাওয়া যায় নি সেদিন। পাওয়া গেছিল সমীরণের নাম। আর রত্না যে কার্ডটায় আমাকে সমীরণ বলে লিখেছিল, সেই নিউ ইয়ার কার্ডটা আমি তৎক্ষণাৎ করবীর চোখের আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছিলাম। লুকিয়ে ফেলেছিলাম... ছিঁড়ে ফেলতে পারিনি। এত বছরে, এতগুলো রাত, এত চেষ্টার পরেও ছিঁড়ে ফেলতে পারিনি। শ্যামলেন্দুর সঙ্গে অবধারিত ভাবে স্যার শব্দটা চলে আসে বলেই, সমীরণ নামটা বেছে নিয়েছিল ও। অথচ সেদিন ওকে শাসন না করার জন্য বিন্দুমাত্র অনুসূচনা হয় না! আমি নিজেও একটা ডাকনাম দিয়েছিলাম... মেঘ। মেঘ আর সমীরণ এর সেই কার্ডটা এখন কোথায়... সেটা বড় কথা নয়। সেই কার্ডটার অস্তিত্ব অস্বীকার করা অন্যায়, এটাই সার কথা। 
রত্নাকে আজ এত বছর পর হাসতে দেখে আবার মেঘ বলে ডাকতে ইচ্ছে করছিল। খুব ডাকতে ইচ্ছে করছিল। বার বার... মেঘ... মেঘ... মেঘ! 

"মেয়েটা অনেকদিন পর আজ একটু হাসিখুশি লাগছিল জানো? এখানে থেকে থেকে চোখ-মুখের যা অবস্থা হয়েছিল!"
করবীর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, ওর ঠোঁটেও একটা অদ্ভুত হাসি। যেন রত্নার হাসিটাই ওর মুখে কেউ কেটে বসিয়ে দিয়েছে। 
"যাক... বাঁচা গেল", আমি বলার সঙ্গে সঙ্গে করবীও প্রতিধ্বনির মত বলল 'বাঁচা গেল'। তারপর আমার কাঁধে মাথাটা আলতো করে ঠেকিয়ে বলল - "আমাকে আর কোনও ডাকনাম দিতে ইচ্ছে হয় না?"


আমি কারও ছাত নই... শুধু কারও কারও কাছে দেওয়াল। মাঝে মাঝে মনে হয়, এমন দেওয়াল হওয়াই ভাল। ছাত হওয়া সকলের সাধ্যে কুলোয় না। 
অথচ আমার নিজের এক চিলতে ছাত দরকার হয় । খুব দরকার হয় । প্রতিদিন দরকার হয়! 

মিত্র বাবুর রেডিওতে আজ রাতের শেষ গান ভেসে আসছে - 

ইয়ে রাত ভীগি ভীগি
ইয়ে মস্ত ফিজায়েঁ... 

                                                          (চিত্রঋণ : Raghu Rai)

2 comments:

  1. চিরায়ত মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের সুর ভেসে এল মিত্রবাবুর রেডিওয়...

    ReplyDelete
  2. ভাষার চাতুর্যে গল্পের সুন্দর উপস্থাপনা। গল্পের চুপকারিতাও বেশ লাগলো। লেখককে ধন্যবাদ।

    ReplyDelete